সরকারি ভূমি ব্যবস্থাপনার সব সেবা একটি অ্যাপে নিয়ে এসেছে খুলনার জেলা প্রশাসন। গত এক বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে অনলাইনের মাধ্যমে চলছে ভূমি সেবা কার্যক্রম।
জেলা প্রশাসনের এমন উদ্যোগের ফলে, কমে গেছে অনিয়ম, সরকারি সম্পত্তি অবৈধ দখলের চেষ্টা। রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ওয়েবসাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে ভূমি সেবা প্রদানের বিষয়টি দেশে এটাই প্রথম।
আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টের মামলার তথ্য জানতে নতুন অ্যাপ চালু
খুলনা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের সকল খাসজমি, জলমহাল, বালু মহাল ইজারা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, অর্পিত সম্পত্তি দেখাশোনা এসব খাত থেকে রাজস্ব আদায় করা জেলা প্রশাসনের অন্যতম কাজ। আবহমান কাল থেকেই বাংলাদেশের ভূমি সংক্রান্ত বিষয়গুলো জটিলতায় ভরা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমির উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারি খাস জমি, ভিপি জমি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, জলমহাল, হাটবাজার চলে যাচ্ছে অবৈধ দখলে। এছাড়া সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জমিজমা ব্যক্তি পর্যায়েও রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে বিশাল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, তদারকী ও রাজস্ব আদায় করা খুবই কঠিন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালে খুলনার একটি ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শনে গিয়ে জেলা প্রশাসক দেখতে পান সরকারের পুরাতন রেকর্ড বইয়ের অনেক পাতা ছেড়া। খতিয়ানের কাগজও খোয়া গেছে। ওই সময়ই জেলার সকল অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, হাটবাজার, খাস জমি ও জলমহালের ছবিসহ বর্তমান অবস্থার তথ্য, এসএ খতিয়ান ও আরএস খতিয়ানের ছবি সম্বলিত তথ্য ভাণ্ডার তৈরির কাজ শুরু হয়।
আরও পড়ুন: ব্যবসার হিসাব রাখার অ্যাপ ‘টালিখাতা’
খুলনার তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সারোয়ার আহমেদ সালেহীন এই কাজে নেতৃত্ব দেন। সরকারি সম্পত্তির ছবিসহ তথ্যভাণ্ডার এটাই প্রথম।
ছবিযুক্ত ডাটাবেজ তৈরির পর খুলনা জেলার সার্বিক ভূমি ব্যবস্থাকে অনলাইন প্লাটফর্মে আনার উদ্যোগে নেন জেলা প্রশাসক। এর অংশ হিসাবে অর্পিত সম্পত্তি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, হাটবাজার, খাস জমি ও জলমহালসহ ভূমি সেবা সংক্রান্ত সকল শাখাকে ডিজিটাল শাখায় রূপান্তরিত করা হয়। ইতোমধ্যে এই শাখাগুলো অনলাইনের আওতায় এসেছে।
সূত্রটি জানায়, এরপরই অনলাইনের মাধ্যমে ভূমি সংক্রান্ত সেবা প্রদানের কাজ শুরু হয়। গত এক বছর ধরে অর্পিত সম্পত্তি শাখার সব ধরনের কাজই অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। যার কারণে দ্রুত সেবা দেওয়া যাচ্ছে এবং ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি কমে গেছে। রাজস্ব আয়ও বেড়েছে।
আরও পড়ুন: স্মার্টফোন আসক্তি দূর করতে গুগলের নতুন ৩ অ্যাপ
খুলনা জেলা প্রশাসনের অর্পিত শাখার প্রধান সহকারী হিসাবে তিন বছর ধরে কর্মরত মো. কবির হোসেন জানান, আগে কেউ আবেদন করলে পুরাতন নথি খুঁজতেই অনেক সময় নষ্ট হতো। কোনো নথি হারিয়ে গেলে তো ভোগান্তির শেষ ছিলো না। এছাড়া যে কোনো আবেদন নিষ্পত্তি করতে ১০/১৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগতো। সেবা গ্রহীতাদের বার বার আসতে হতো। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে অনলাইন করার পর ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেবা দেওয়া সম্ভব হয়।
তিনি জানান, সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে অর্পিত সম্পত্তির সব ধরনের তথ্য ওয়েবসাইটে রয়েছে। এখন নথির জন্য দৌড়াতে হয় না। কম্পিউটারে বসেই কোন সম্পত্তি কোথায় রয়েছে, কতটাকা রাজস্ব বাকিসহ সব ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। একবছর আগে এটা কল্পনাও করা যেত না।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জিয়াউর রহমান জানান, অনলাইনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নথি আর্কাইভ করায় কাগজে নথি বিনষ্টের সম্ভাবনা কমেছে। এক ক্লিকেই ছবিসহ জমির সার্বিক অবস্থা, লিজ কেস সংক্রান্ত মামলাসহ আনুষঙ্গিক তথ্য থাকায় সহজেই লিজ নবায়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাচ্ছে। সফটওয়্যারে রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যার মাধ্যমে জমির অবস্থান, লিজকৃত মূল্য, বর্তমান ইজারাদার, জমির শ্রেণি, লিজের মেয়াদ এবং সরকারি পাওনা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরুর পরই আমরা শতভাগ সফলতা পেয়েছি। খুলনা জেলা প্রশাসনের সব বিভাগেরই রাজস্ব আদায় বেড়েছে। শুধুমাত্র ১৪২৬ সালেই হাটবাজার ইজারা থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। যা’ রেকর্ড। এছাড়া জলমহাল থেকে রাজস্ব আদায় ৪০ দশমিক ৩১ শতাংশ, অর্পিত সম্পত্তির রাজস্ব বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
তিনি বলেন, সফটওয়্যারটি সব সময় আপডেট করা হবে। যার কারণে নিত্য নতুন বিষয়গুলো এই অ্যাপে পাওয়া যাবে।সারাদেশে এটা বাস্তবায়িত করা গেলে দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি মাইলফলক তৈরি হবে।